চীনের দুর্লভ মৃত্তিকা আঁকড়ে ধরা: এআই বিপ্লবের জ্বালানি
চীনের উক্সি শহরের বাইরের বিশাল শিল্পাঞ্চলে এমন একটি শোধনাগার দাঁড়িয়ে আছে যা অন্য যেকোনোটির চেয়ে আলাদা। এর ভেতরেই রয়েছে বিশ্বের একমাত্র অতি বিশুদ্ধ ডিসপ্রোসিয়াম উৎপাদনকারী, যা বর্তমানে অত্যাধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চিপ তৈরির জন্য অপরিহার্য একটি দুর্লভ মৃত্তিকা ধাতু। আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ এই সুবিধাটি একটি বৃহত্তর, কয়েক দশক-ব্যাপী কৌশলের মূল অংশ: দুর্লভ মৃত্তিকা উপাদানগুলির বাজার দখলের জন্য চীনের নিরলস প্রচেষ্টা, যে অভিযানটি ইনার মঙ্গোলিয়ার ধুলিময় সমভূমিতে শুরু হয়েছিল।
এই গল্পের শুরু ১৯৬৪ সালের এপ্রিলে, মঙ্গোলীয় সীমান্ত থেকে ৫০ মাইল দূরে অবস্থিত বাওতোউ শহরের কাছে একটি লোহার আকরিক খনিতে। চীনা ভূতত্ত্ববিদরা এমন একটি আবিষ্কারের সম্মুখীন হয়েছিলেন যা বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিগত দৃশ্যপটকে নতুন আকার দেবে: বিশ্বের বৃহত্তম দুর্লভ মৃত্তিকার ভাণ্ডার। এই ১৭টি উপাদান, যেগুলোর অনন্য চৌম্বকীয় এবং পরিবাহী বৈশিষ্ট্য রয়েছে, আধুনিক যুগের নীরব নায়ক হতে চলেছে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন উদীয়মান তারকা দেং জিয়াওপিং তাৎক্ষণিকভাবে এর তাৎপর্য উপলব্ধি করেছিলেন। প্রত্যন্ত খনি পরিদর্শনের সময় তিনি ঘোষণা করেছিলেন, "আমাদের ইস্পাত উৎপাদন করতে হবে, এবং আমাদের দুর্লভ মৃত্তিকাও উৎপাদন করতে হবে," যা আগামী ছয় দশকে উন্মোচিত হতে যাওয়া একটি জাতীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে পূর্বাভাস দেয়।
পৃথিবীর ভূত্বকে প্রাচুর্যের দিক থেকে দুর্লভ মৃত্তিকা উপাদানগুলো আসলে বিরল নয়। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ হলো এগুলোকে ব্যবহারযোগ্য রূপে নিষ্কাশন এবং প্রক্রিয়াকরণের অসুবিধা ও ব্যয়। স্মার্টফোন থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক যানবাহন, বায়ু টারবাইন থেকে ক্ষেপণাস্ত্রGuidance system, এই উপাদানগুলো অসংখ্য প্রযুক্তির ভিত্তি। বিশেষ করে, ডিসপ্রোসিয়াম বৈদ্যুতিক মোটর এবং অতি সম্প্রতি, এআই সিস্টেমকে চালিত করা অত্যাধুনিক চিপগুলোতে ব্যবহৃত উচ্চ-শক্তির চুম্বকের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উক্সিতে বিশেষভাবে উৎপাদিত এর অতি বিশুদ্ধ রূপটি আরও দক্ষ এবং শক্তিশালী এআই প্রসেসর তৈরি করতে সহায়তা করে, যা দ্রুত ডেটা প্রক্রিয়াকরণ এবং আরও জটিল অ্যালগরিদম তৈরি করতে সক্ষম।
দুর্লভ মৃত্তিকাতে চীনের আধিপত্য রাতারাতি আসেনি। এটি ছিল গবেষণা ও উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ, সুবিন্যস্ত পরিবেশগত বিধিবিধান (অন্তত প্রাথমিকভাবে) এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় দাম কমিয়ে বাজার দখলের জন্য কম লাভের মার্জিন মেনে নেওয়ার ইচ্ছার সমন্বয়ে একটি পরিকল্পিত, দীর্ঘমেয়াদী কৌশল। পশ্চিমা কোম্পানিগুলো, কঠোর পরিবেশগত মান এবং উচ্চ শ্রম ব্যয়ের সম্মুখীন হয়ে ধীরে ধীরে পিছু হটতে থাকে, যার ফলে চীন ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে বিশ্বব্যাপী দুর্লভ মৃত্তিকা উৎপাদনের ৮০% এরও বেশি দখল করে নেয়।
এই প্রায়-একচেটিয়া আধিপত্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যতের জন্য গভীর প্রভাব ফেলে। যেহেতু এআই আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমানভাবে একত্রিত হচ্ছে, স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে ফিনান্স এবং জাতীয় নিরাপত্তা পর্যন্ত, ডিসপ্রোসিয়ামের মতো মূল উপাদানগুলোর নিয়ন্ত্রণ চীনকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সুবিধা দেয়। এমন একটি পরিস্থিতির কল্পনা করুন যেখানে চীনের বাইরের কোম্পানিগুলোর জন্য অতি বিশুদ্ধ ডিসপ্রোসিয়ামের সরবরাহ সীমিত বা অত্যধিক বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এটি এআই-এর উদ্ভাবনকে স্তব্ধ করে দিতে পারে, যার ফলে চীনা কোম্পানিগুলো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বিকাশে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে যাবে।
প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পদার্থ বিজ্ঞানী ডঃ এমিলি কার্টার বলেন, "দুর্লভ মৃত্তিকার পরিস্থিতি একটি সতর্কবার্তা। "আমরা এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোর জন্য একটি উৎসের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। এটি কেবল অর্থনীতির বিষয় নয়; এটি জাতীয় নিরাপত্তা এবং প্রযুক্তিগত নেতৃত্বের বিষয়।"
এর প্রভাব শুধু এআই-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। নবায়নযোগ্য জ্বালানির উপর এর ব্যাপক প্রভাবের কথা বিবেচনা করুন। নিওডিয়ামিয়াম, আরেকটি দুর্লভ মৃত্তিকা উপাদান, বায়ু টারবাইনে ব্যবহৃত শক্তিশালী চুম্বকের জন্য অপরিহার্য। নিওডিয়ামিয়ামের সরবরাহ ব্যাহত হলে পরিচ্ছন্ন জ্বালানিতে বিশ্বব্যাপী পরিবর্তনের পথে বাধা সৃষ্টি হতে পারে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রচেষ্টাকে প্রভাবিত করবে।
সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো উপলব্ধি করে পশ্চিমা সরকার এবং কোম্পানিগুলো এখন তাদের দুর্লভ মৃত্তিকা সরবরাহ চেইনকে বহুমুখী করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ায় খনি পুনরায় চালু করার এবং নতুন প্রক্রিয়াকরণ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা চলছে যা পরিবেশ বান্ধব। তবে, চীনের কয়েক দশক-ব্যাপী অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে।
দুর্লভ মৃত্তিকার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। চীন কি তার আধিপত্য বজায় রাখবে, নাকি অন্যান্য দেশ প্রতিযোগিতামূলক শিল্প গড়ে তুলতে সফল হবে? এর উত্তর সম্ভবত প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, সরকারি নীতি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সংমিশ্রণের উপর নির্ভর করবে। একটি বিষয় স্পষ্ট: দুর্লভ মৃত্তিকার আধিপত্যের দৌড় এখনও শেষ হয়নি, এবং ঝুঁকির পরিমাণ আগের চেয়ে অনেক বেশি। উক্সিতে পরিশোধিত অতি বিশুদ্ধ ডিসপ্রোসিয়াম কেবল একটি ধাতু নয়; এটি একটি বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার লড়াইয়ের প্রতীক যা প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ এবং ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্যকে রূপ দেবে।
Discussion
Join the conversation
Be the first to comment